ডাক্তার মনিকা বেগ

এ পর্যন্ত প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে আমি – ৯ জুন থেকে ১৮ জুন ২০২৩ – ঐ দশ দিনের ঘটনা এবং অঘটনার একটি টাইমলাইন করার চেষ্টা করেছি। চলুন দেখি ঐ দশ দিনে কি ঘটেছিল, কখন ঘটেছিল, এবং তাতে কার কি ভূমিকা ছিল।
৯ জুন ২০২৩ দুপুর ১২ টা থেকে রাত ১০টা
ঐদিন দুপুরের দিকে মাহবুবা রহমান আঁখির প্রসব বেদনা শুরু হলে, পরিবারের সদস্যরা আঁখিকে কুমিল্লা জেলার তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। আনুমানিক দুপুর ১২ টা ৫০ মিনিটের দিকে আঁখি তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়।কর্তব্যরত চিকিৎসক আঁখির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মতামত দেন যে, আঁখির ‘obstructed labor’ আছে, যেই কারণে স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা প্রসব (নরমাল ডেলিভারি) সম্ভব না। জরুরি ভিত্তিতে তার সিজারিয়ান অপারেশন করাতে হবে।
কিন্তু তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজারিয়ান অপারেশন করার মত কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছিলেন কি না, সেই বিষয়ে আঁখির হাসবেন্ড ইয়াকুব আলীকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কেউ নিশ্চিত করতে পারেন নি। সেই সময়ে, সেখানে উপস্থিত কয়েকজন আঁখিকে স্থানীয় প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে সিজারিয়ান অপারেশন করাতে উপদেশ দেয়। কিন্তু আঁখি যেহেতু আগে থেকেই ডাক্তার সংযুক্তা সাহার অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন, এবং ডাক্তার সংযুক্তা সাহা যেহেতু নিশ্চিত করেছিলেন তিনি আঁখির নরমাল ডেলিভারি করাবেন, তাই আঁখির অনুরোধে তার হাসবেন্ড ডাক্তার সংযুক্তা সাহার সহকারী জমিরের সাথে যোগাযোগ করে ঐ রাতেই ডাক্তার সংযুক্তা সাহাকে সরাসরি দেখানোর নিমিত্তে আঁখির জন্য একটি সিরিয়াল নম্বর নেন। জমিরকে ইয়াকুব এটাও বলেন যে, তাদের পৌঁছাতে রাত সাড়ে এগারোটা থেকে বারোটাও বাজতে পারে। কিন্তু জমির নিশ্চিত করেন যে দেরি হলেও ডাক্তার সংযুক্তা সাহা সেন্ট্রাল হাসপাতালে থাকবেন এবং আঁখিকে দেখবেন।
[এখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, বিশেষ করে যারা মেডিকেল কমিউনিটির সদস্য নন তাদের মনে, Obstructed labor (OL) কি?
খুব সাধারণ ভাষায় বললে, যখন প্রসবকালীন সময়ে, জরায়ুর শক্তিশালী সংকোচন সত্ত্বেও, কোন বাধার কারণে বাচ্চা মায়ের শ্রোণী বা তলপেটের (pelvis) মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে পারে না, তখন সেটাকে অবস্ট্রাক্টেড লেবার (OL) বলে। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ৩-৬% সন্তান-সম্ভবা মা OL এ ভোগেন। মাতৃমৃত্য এবং প্রসবজনিত অসুস্থতার পাঁচটি প্রধান কারণের মধ্যে OL একটি অন্যতম কারণ। শুধু তাই নয়, মৃত বাচ্চা (still birth) জন্ম হওয়ারও একটি প্রধান কারণ হলো অবস্ট্রাক্টেড লেবার।
কি কি কারণে OL হতে পারে:
অধিকাংশ ক্ষেত্রে, মায়ের শ্রোণীর আকার বাচ্চার আকারের তুলনায় ছোট হলে, অথবা মায়ের পেটে বাচ্চার অবস্থান অনুকূল না হলে, OL হয়। তবে কিছু বিরল ক্ষেত্রে, যেমন মায়ের পেটের অভ্যন্তরে বাচ্চার Hydrocephalus এর কারণে বাচ্চার মাথা অস্বাভাবিক ভাবে বড় হয়ে গেলে, যমজ বাচ্চার ক্ষেত্রে একটি বাচ্চা আরেকটি বাচ্চার সাথে আটকে গেলে (locked twins), অথবা মায়ের তলপেটে টিউমার থাকলেও, OL হতে পারে।
OL এর জটিলতা:
লম্বা সময় ধরে যদি মা OL এ থাকে, তাহলে মায়ের তলপেটে আটকে থাকা বাচ্চা মায়ের মূত্রথলি, জরায়ু মুখ, যোনিপথ এবং মলদ্বারের উপর অত্যধিক চাপ সৃষ্টি করে। সেই চাপে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে মায়ের মূত্রথলি, জরায়ু মুখ, যোনিপথ এবং মলদ্বারের কোন জায়গায় পচন ধরতে পারে, যা পরবর্তীতে ফিস্টুলায় রূপান্তরিত হতে পারে। শুধু তাই নয়, অত্যধিক চাপে মায়ের জরায়ু ফেটে গিয়ে অস্বাভাবিক রক্ত ক্ষরণে মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। একই ভাবে, তলপেটে লম্বা সময় ধরে আটকে থাকার কারণে বাচ্চার আম্বিলিক্যাল কর্ডের উপরও অত্যধিক চাপ সৃষ্টি হয়ে বাচ্চার শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গিয়ে পেটের ভিতরেই বাচ্চা মারা যেতে পারে।
OL এর চিকিৎসা কি:
এটি একটি মেডিকেল ইমার্জেন্সী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, সময় মত সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে বাচ্চাকে বের করে এনে মা এবং বাচ্চা দুজনেরই জীবন বাঁচানো সম্ভব। অল্প কিছু ক্ষেত্রে, সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে, বিশেষ যন্ত্র পাতি (যেমন ফোর্সেপ, ভ্যাকুয়াম নিষ্কাশন) ব্যবহার করে বা সিম্ফিজিওটমি (symphysiotomy) অর্থাৎ মায়ের শ্রোণীর হাড় কেটেও বাচ্চাকে বের করে আনা হয়। তবে এই পদ্ধতি গুলোর কোনটিই মা এবং বাচ্চার জন্য ঝুঁকি মুক্ত নয়।]
৯ জুন ২০২৩ রাত ১০ টা
আঁখির হাসবেন্ড একটি প্রাইভেট কার রিজার্ভ করে নরমাল ডেলিভারি করানোর জন্য আঁখিকে নিয়ে তিতাস থেকে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তারা গাড়িতে আসতে আসতে এটাও আলাপ করেন যে, পৌঁছাতে বেশি রাত হয়ে যাওয়ার কারণে যদি ডাক্তার সংযুক্তা সাহা সেন্ট্রাল হাসপাতালে না থাকেন, তবে তারা আদদ্বীন হাসপাতালে চলে যাবেন।
৯ জুন ২০২৩ রাত ১১ টা
ডাক্তার সংযুক্তা সাহা তার নিজস্ব টিমের ডাক্তার শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানাকে ফোন করে কুমিল্লার রোগী (আঁখি) এসেছে কিনা জানতে চান। ডাক্তার শাহজাদী না সূচক উত্তর দেন। ডাক্তার সংযুক্তা সাহা তখন ডাক্তার শাহজাদীকে জানান, তিনি সোমবার আসবেন। কুমিল্লার রোগী এলে যেন ডাক্তার শাহজাদী দেখেন, এই বলে তিনি ফোন কেটে দেন।
৯ জুন দিবাগত আনুমানিক রাত ১২:২৫
আঁখির হাসবেন্ড আঁখিকে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে ডাক্তার সংযুক্তা সাহার অধীনে ভর্তি করেন। ডাক্তার সংযুক্তা সাহা কোথায় এই প্রশ্নের উত্তরে তাকে বার বার বলা হয় ডাক্তার সংযুক্তা সাহা ভিতরে প্রসব কক্ষে রোগী নিয়ে ব্যস্ত আছেন। এখানে উল্লেখ্য যে ডাক্তার সংযুক্তা সাহা তখন সেন্ট্রাল হাসপাতালে না থাকলেও ঢাকাতেই ছিলেন। আঁখি সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘণ্টা খানেক পরেই রাত ১:৪০ এর ফ্লাইটে ডাক্তার সংযুক্তা সাহা নাকি দুবাই এর উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন।
১০ জুন ২০২৩ সময় রাত ১২:৩০ থেকে রাত ২:৫০
রাত সাড়ে ১২ টায় সেন্ট্রাল হাসপাতালের ডিউটি ডাক্তার মুনা সাহা ফোন করে ডাক্তার শাহজাদীকে কুমিল্লা থেকে রোগী আসার কথা জানান। রাত ১ টায় ডাক্তার শাহজাদী হাসপাতালে উপস্থিত হন।
– আঁখিকে সেন্ট্রাল হাসপাতালের প্রসব কক্ষে (labour room) নেয়া হয়। ডাক্তার সংযুক্তা সাহার নির্দেশ অনুযায়ী ডাক্তার শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা ভ্যাকুয়াম নিষ্কাশনের মাধ্যমে আঁখির নরমাল ডেলিভারি করানোর চেষ্টা করেন। নরমাল ডেলিভারি সহজ করানোর উদ্দেশ্যে তিনি আঁখির episiotomy ও করেন। এক পর্যায়ে আঁখির গর্ভের বাচ্চার হার্ট বিট উঠা নামা করছে দেখে, ডাক্তার শাহজাদী তিনবার অধ্যাপক সামিনা চৌধুরীকে ফোন দেন। কিন্তু তিনি একবারও ফোন ধরেননি।
[প্রসব কালীন সময়ে, মায়ের যোনিপথের মুখকে বড় করার জন্য, অনেক ক্ষেত্রেই, যোনিপথ এবং মলদ্বারের মধ্যবর্তী অংশে (পেরিনিয়ামে) কাঁচি দিয়ে একটু কেটে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিটিকে episiotomy বলে। প্রসবের পরে কাটা জায়গাটি আবার সেলাই করে বন্ধ করে দেয়া হয়।]
– প্রসব কক্ষেই আঁখির কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট (হার্ট অ্যাটাক) হয়। এমতবস্থায়, তারা জরুরি ভিত্তিতে আঁখিকে প্রসব কক্ষ থেকে অপারেশন থিয়েটারে স্থানান্তরিত করেন।
– অপারেশন থিয়েটারে থাকা anesthesiologist ডাক্তার এহসান জামিল এবং শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার সাখাওয়াত আলম CPR এবং বিভিন্ন জরুরি ওষুধ প্রয়োগ করে আঁখির ব্লাড প্রেসার, পালস এবং শ্বাস প্রশ্বাস ফিরিয়ে আনলেও আঁখির সার্বিক অবস্থার কোন উন্নতি হয় না।
– এই পরিস্থিতিতে, ডাক্তার জামিল ও ডাক্তার আলম, ডাক্তার শাহজাদীকে অনুরোধ করেন জরুরি ভিত্তিতে আঁখির পেট থেকে বাচ্চা বের করে আনতে। ইমারজেন্সি সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে ডাক্তার শাহজাদী আঁখির বাচ্চাকে বের করে আনেন। কিন্তু আঁখির জরায়ু থেকে তখন প্রচণ্ড রক্ত ক্ষরণ শুরু হওয়ায় আঁখির অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।
– ওদিকে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে বাচ্চা বের করার পর বাচ্চা কাঁদছিল না। ডাক্তার আলম তখন বাচ্চাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করতে থাকেন এবং ডাক্তার শাহজাদী বাচ্চাকে এনআইসিইউতে (NICU) নিয়ে যান।
১০ জুন ২০২৩ রাত ২:৩৪
ইতিমধ্যে ডাক্তার মুনা এবং ডাক্তার শাহজাদীর অনুরোধে সেন্ট্রাল হাসপাতাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ থেকে ডাক্তার মাকসুদা ফরিদা আক্তার মিলির মুঠোফোনে ফোন যায়। ডাক্তার মিলি তখন বাসায় ঘুমাচ্ছিলেন। ঘুম থেকে জেগে ডাক্তার মিলি ফোন ধরলে, তাকে বলা হয় একজন রোগীর অবস্থা খুব সংকটাপন্ন, অনতিবিলম্বে ডাক্তার মিলি যেন সেন্ট্রাল হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে ঐ রোগীকে দেখেন।
স্বাভাবিক ভাবেই ডাক্তার মিলি তখন জানতে চান রোগী কে, কার অধীনে ভর্তি, কিসের রোগী, এ পর্যন্ত কি কি চিকিৎসা হয়েছে ইত্যাদি। তখনই প্রথম ডাক্তার মিলি জানতে পারেন যে ঐ রোগী ডাক্তার সংযুক্তা সাহার অধীনে ভর্তি এবং ডাক্তার সংযুক্তা সাহা ঐ মুহূর্তে দেশে নেই।
১০ জুন ২০২৩ রাত ২:৫২ থেকে রাত ২:৫৪
সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে ফোন পাওয়ার ১৮ মিনিটের মধ্যে রাত ২:৫২ তে ডাক্তার মিলি সেন্ট্রাল হাসপাতালের ৩য় তলায় অবস্থিত অপারেশন থিয়েটারের সামনে পৌঁছান। এবং আঁখির হাসবেন্ডের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে তার সাথে কথা বলে রাত ২:৫৪ তে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকেন।
১০ জুন ২০২৩ রাত ২:৫৪ থেকে ভোর ৪:৫০
ডাক্তার মিলি অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে আঁখির জরায়ু থেকে ব্লিডিং বন্ধ করার জন্য যা যা জরুরি টেকনিক আছে সব গুলো ব্যবহার করেন। এবং একই সাথে ইতিপূর্বে প্রসব কক্ষে ডাক্তার শাহজাদীর করা episiotomy র কাটা জায়গাটিও সেলাই করে বন্ধ করেন। কিন্তু ডাক্তার মিলি লক্ষ্য করেন যে, আঁখি শকে (shock) চলে যাচ্ছে। এই অবস্থায়, উপস্থিত সকল ডাক্তারের সিদ্ধান্ত ক্রমে আঁখিকে দ্রুত সেন্ট্রাল হাসপাতালের ICU তে স্থানান্তর করা হয়।
(শক হলো একটি গুরুতর অবস্থা যা রোগীর শরীরে হঠাৎ করে রক্ত ​​প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে ঘটে। যখন একজন ব্যক্তি শকে থাকে, তখন তার শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলি পর্যাপ্ত রক্ত ​​বা অক্সিজেন পায় না। যদি জরুরি ভিত্তিতে শকের চিকিৎসা না করা হয়, তবে শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ সমূহের স্থায়ী ক্ষতির সাথে সাথে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।)
১০ জুন ২০২৩ বিকেল ৩:৩৯
আঁখির অবস্থার ক্রমবর্ধমান অবনতি এবং সেন্ট্রাল হাসপাতালের অসহযোগিতার কারণে, পুলিশের সহায়তা নিয়ে আঁখির হাসবেন্ড আঁখিকে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় অ্যাম্বুল্যান্সে করে ল্যাব এইড হাসপাতালের CCU তে স্থানান্তর করেন। এবং তখনই তিনি প্রথম জানতে পারেন, ১০ জুন বিকালেই নাকি তাদের নবজাতক পুত্র সন্তান সেন্ট্রাল হাসপাতালের NICU তে মারা গেছে।
১৮ জুন ২০২৩ দুপুর ১:৪৩
ল্যাব এইড হাসপাতালের CCU তে, মাত্র ২৫ বছর বয়সে ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজের উচ্চতর গণিত বিষয়ের শেষবর্ষের ছাত্রী আঁখি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
প্রশ্ন:
# তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কি সিজারিয়ান অপারেশন করার ব্যবস্থা আছে? যদি থাকে তাহলে উনারা কি সেই তথ্য যথাযথ ভাবে রোগী এবং তার পরিবারকে দিয়েছিলেন?
# তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যদি সিজারিয়ান অপারেশন করার ব্যবস্থা না থাকে, সেই ক্ষেত্রে উনারা কি রোগীকে কাছাকাছি এবং নির্ভরযোগ্য কোন হাসপাতালে রেফার করেছিলেন যেখানে সিজারিয়ান অপারেশন করে?
# রোগী যখন নরমাল ডেলিভারি করানোর জন্য বার বার ঢাকায় যেতে চাইছিল, তখন উনারা কি রোগী এবং তার হাজবেন্ডকে কাউন্সেলিং করেছিলেন? বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে একজন প্রসূতি যিনি প্রায় ৯/১০ ঘণ্টা ধরে OL এ আছেন, তাকে কয়েক ঘণ্টা জার্নি করে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় নিয়ে গেলে মা এবং সন্তান উভয়ের জন্যই সেটি কত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে?
# আঁখির হাসবেন্ড যখন তিতাস থেকে ঢাকায় ডাক্তার সংযুক্তা সাহার সহকারী জমিরকে ফোন করেন, তখন তিনি তাকে আঁখির OL এর কথা বলেছিলেন কিনা। যদি না বলে থাকেন তবে ঘটনার দায়ভার আঁখির হাসবেন্ডের কাঁধেও আসবে। কিন্তু তিনি যদি বলে থাকেন এবং জমির যদি সেটা ডাক্তার সংযুক্তা সাহাকে জানিয়ে থাকেন, তাহলে ঘটনার প্রায় পুরো দায়ভার ডাক্তার সংযুক্তা সাহার ওপর শুধু বর্তাবেই না, এটা criminal negligence এর পর্যায়ে চলে যাবে। সবার কল রেকর্ডগুলো ফরেনসিক বিশ্লেষণ করলেই এই তথ্য গুলো বের হয়ে আসবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ সেটা করবেন কি না?
# ডাক্তার সংযুক্তা সাহা নরমাল ডেলিভারি করানোর গ্যারান্টি দিয়ে social media তে যে অনৈতিক প্রচার প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তার অর্থনৈতিক বেনিফিশিয়ারি কি শুধু ডাক্তার সংযুক্তা সাহা? সেন্ট্রাল হাসপাতালও কি এতদিন এর ফায়দা লোটেনি?
# স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, DGHS, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (BMA), BMDC, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ সবার নাকের ডগাতেই এগুলো হচ্ছিল, এবং আরও অনেক কিছু হচ্ছে। উনারা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমান? উনাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যদি উনারা পালন না করেন, তাহলে উনারা ঐ সব অফিস এবং পদ দখল করে আছেন কেন?
# BMDC রেজিস্ট্রেশন ছাড়া ডাক্তার সংযুক্তা সাহা রোগী দেখেন কি করে? তাও আবার এত খোলাখুলি ভাবে এবং এত দাপটের সাথে?
# ডাক্তার সংযুক্তা সাহা দেশে না থাকলেও, তার নামে রোগী ভর্তি হয় কি করে? তাও আবার রোগীর কাছে সেটা গোপন করে, এবং মিথ্যা কথা বলে। এর দায় কার?
# বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আউট অফ স্টেশন থাকলেও, সেই তথ্য গোপন করে তার অধীনে রোগী ভর্তি করার এই প্র্যাক্টিস সেন্ট্রাল হাসপাতালে আগে থেকেই আছে। কতৃপক্ষের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে সিনিয়র ডাক্তাররা রোগীদের জিম্মি করে ওখানে অনৈতিক ব্যবসা চালিয়ে গেছেন। এখন ধরা পড়ে, সব দোষ ডাক্তার সংযুক্তা সাহার উপর চাপিয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কি পার পেয়ে যাবে?
# একজন প্রসূতি যে প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে OL এ আছে, সেন্ট্রাল হাসপাতালে তাকে নরমাল ডেলিভারি করানোর চেষ্টা করা হলো কেন? কেন তার সরাসরি সিজারিয়ান অপারেশন করা হলো না?
# ডাক্তার সংযুক্তা সাহা, যিনি একদিকে নরমাল ডেলিভারি নিয়ে মিডিয়া হাইপ সৃষ্টির মাধ্যমে রোগীদের বিভ্রান্ত করে তাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন, অন্যদিকে তার ঐ স্কিম বাস্তবায়ন করার জন্য তার অধীনে কাজ করা জুনিয়র ডাক্তারদের গালি গালাজ করে, ভয় ভীতি দেখিয়ে তাদেরকেও অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করেছেন, তিনি এর দায় কি করে এড়াবেন?
# সেন্ট্রাল হাসপাতালের মত একটি পুরানো নামকরা হাসপাতালে, যেখানে আমাদের বাঘা বাঘা অধ্যাপকরা জড়িত, সেখানে কেমন করে কোন প্রটোকল অনুসরণ করা ছাড়াই যার যেমন ইচ্ছা তেমন করে রোগীদের চিকিৎসা দিতে পারেন? কোথায় তাদের ম্যানেজমেন্ট? কোথায় তাদের কোয়ালিটি কন্ট্রোল? কোথায় তাদের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা?
# জুনিয়র ডাক্তাররা যাতে নির্ভয়ে এবং সততার সঙ্গে কাজ করতে পারেন এবং কাজ শিখতে পারেন তার পরিবেশ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা কোথায়?
# নাকি বিপদ দেখলেই, নিজেদের বাঁচাতে জুনিয়র ডাক্তারদের অন্য কথা বলে বাড়ি থেকে হাসপাতালে ডাকিয়ে এনে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার মধ্যেই (ডাক্তার মুনা এবং ডাক্তার শাহজাদীর বেলায় যা ঘটেছে) সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা সীমাবদ্ধ?
# এত কিছুর পরও, সব অপকর্ম ধামা চাপা দিতে ডাক্তার মুনা এবং ডাক্তার শাহজাদীর মত জুনিয়র ডাক্তারদের, যাদের ডাক্তার সংযুক্তা সাহার হুকুম ছাড়া রোগীর গায়ে হাত দেবার পর্যন্ত ক্ষমতা নেই, বলির পাঁঠা বানিয়ে বিনা বিচারে জামিন না দিয়ে জেল হাজতে পচানো হচ্ছে। এগুলো দেখার কেউ নেই?
# নিজের রোগী না হওয়া সত্বেও, নিছক মানবিক কারণে এবং পেশার প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে, যেই ডাক্তার মিলি রাত আড়াইটায় ফোন পাওয়ার ১৮ মিনিটের মধ্যে নিজের ঘুম এবং বিশ্রাম বিসর্জন দিয়ে, সেন্ট্রাল হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে আঁখির জীবন বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেন, তাকে কি কারণে, কার ইশারায় এখন হেনস্থা করা হচ্ছে?
এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর জানা খুব দরকার।
আজ ডাক্তার সমাজ এবং বৃহত্তর সমাজের এই যে মুখোমুখি সাংঘর্ষিক অবস্থান, এটি এক দিনে একজন আঁখি এবং তার সদ্যোজাত সন্তানের মৃত্যুতে সৃষ্টি হয় নি। গত পঞ্চাশ বছরে, সৎ, যোগ্য এবং দূরদর্শী চিকিৎসক নেতৃত্বের অভাবে, একটু একটু করে আমরা ডাক্তাররাই এই অসহনীয় অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে দিয়েছি। আমাদের মাত্রাতিরিক্ত লোভের কারণে, মেডিকেল এথিক্স (medical ethics) এবং পেশাগত দায়িত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে আমরা পরিণত হয়েছি রাজনৈতিক দল গুলোর মোসাহেবে, বিক্রি হয়ে গেছি ফার্মা কোম্পানি এবং কর্পোরেট ক্লিনিক, হাসপাতাল এবং ডায়াগ্নস্টিক ল্যাবরেটরি গুলোর কাছে, আটকে গেছি সরকারি হাসপাতালের তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের সিন্ডিকেটের জালে।
সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন বাবা-মায়েরা আর চাইবেন না তাদের ছেলে-মেয়েরা ডাক্তারী পড়ুক, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা আর খেলনা স্টেথো নিয়ে ডাক্তার-ডাক্তার খেলবে না।
সময় এসেছে আমাদের আত্ম-অনুসন্ধান করার। প্রয়োজনে সব ভেঙে চুরে নতুন করে গড়ার।


লেখক:
ডাক্তার মনিকা বেগ
অবসরপ্রাপ্ত প্রধান এবং বৈশ্বিক সমন্বয়ক,
এইডস সেকশন, জাতিসংঘ সদর দপ্তর,
ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া।